দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই তাপপ্রবাহ বইছে। এরমধ্যে ৯টি অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। এসব অঞ্চলে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ ডিগ্রির উপরে। তাপপ্রবাহের সঙ্গে বাড়ছে হাসপাতালে রোগী। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষ বেশি অসুস্থ হচ্ছেন।
একসঙ্গে এত অঞ্চলের তাপমাত্রা বেশি হওয়ার রেকর্ড বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে উঠেছে কিনা, তার ঠিক তথ্য নেই আবহাওয়া অধিদপ্তরে। সংস্থাটি বলছে, আবহাওয়া এমন থাকতে পারে আগামী ১০ দিন পর্যন্ত। এমনকি তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি ছাড়াতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। এদিকে দেশজুড়ে জারি হওয়া হিট অ্যালার্টও আগের মতো বলবৎ আছে। শনিবার বিকেলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছে।
আবহাওয়াবিদ ড. আবুল কালাম মল্লিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই তাপপ্রবাহ চলতি সপ্তাহজুড়ে থাকতে পারে। আমরা পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারি। তাদের তাপমাত্রা কমার কোনো লক্ষণ নেই। তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আছে। আজকে একসঙ্গে ৯টি অঞ্চলে তাপমাত্রা যে ৪০ ডিগ্রির উপরে উঠেছে, এর আগে কবে এমন উঠেছিল কি না তা এখনই বলা সম্ভব না। আমরা তথ্য বিশ্লেষণ করছি। সর্বশেষ পাবনায় গতবছরে একদিন ৪৩ ডিগ্রিতে তাপমাত্রা উঠেছিল। এটা সম্ভবত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।”
চলমান তীব্র তাপদাহের কারণে সারা দেশে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। ঘোষণা অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয় আগামী ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে আবহাওয়া পরিস্থিতি পরিবর্তন সাপেক্ষে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতে পারে বলেও জানানো হয়েছে। শনিবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে একথা জানায়। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চলমান তাপদাহ ও আবহাওয়া দপ্তরের সতর্কতা জারির প্রেক্ষিতে আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সব স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে এমনটা হচ্ছে। আমরা যেটা বুঝতে পারি, এখন আবহাওয়া এক ধরনের অনিয়মিত অবস্থায় চলে গেছে। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। আগে আমরা ঋতু ধরে বলতে পারতাম কখন কী হবে। কিন্তু এখন সেটা বলা সম্ভব না। এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে না, সারা বিশ্বেই এমন অবস্থা। এটার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছি। আরেকটা বিষয় হলো শিল্পায়নের আগে যে তাপমাত্রা ছিল, শিল্পায়নের পর তাপমাত্র এক ডিগ্রি বেড়ে গেছে। ফলে আমরা যে উষ্ণতার দিকে যাচ্ছি, সেটা তো আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল। এখন সেটাই হচ্ছে।”
এদিকে তীব্র তাপপ্রবাহে পাবনা শহরে হিট স্ট্রোকে একজনের মৃত্যু হয়েছে। সুকুমার দাস (৬০) নামে ওই ব্যক্তি শনিবার দুপুরে পাবনা শহরের রূপকথা রোডে একটি চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময় হিট স্ট্রোক হ। এ সময় আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সুকুমার দাস শহরের শালগাড়িয়ার জাকিরের মোড়ের বাসিন্দা। অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গায় হিট স্ট্রোকে জাকির হোসেন (৩৩) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়। শনিবার সকালে তিনি মাঠে গেলে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। গত কয়েকদিন ধরে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চলছিল। জাকির হোসেনের বাবা আমির হোসেন বলেন, "তীব্র গরমে মাঠের ধান মরার মতো অবস্থা। ধানের জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য সকাল ৮টার দিকে মাঠে যায় জাকির হোসেন। মাঠে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর খবর পাই ছেলের স্ট্রোক হয়েছে। মাঠের অন্য কৃষকেরা ছেলেকে উদ্ধার করে দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথের মধ্যেই সে মারা যায়।”
আবহাওয়ার এই পরিবর্তন কেন? জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ও ব্র্যাকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক গওহাব নঈম ওয়ারা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "খুব বেশি পরিবর্তন তো আমি দেখছি না।গরম কালে তো গরম পড়বেই। তবে আবহাওয়ার কিছু পরিবর্তন তো আছেই। আর আমরাই আসলে এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী। গাছ কেটে আমরা কংক্রিটের শহর বানাচ্ছি। আবার ঢাকা শহরেই দেখেন রমনা পার্কে তাপমাত্রা কত? আর মতিঝিলে তাপমাত্রা কত? এক শহরেই দুই রকম অবস্থা। শুধু তাই না, ঢাকা শহরে যে গাছগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো ইউক্যালেকটাস বা শিমুল কাছ। এগুলো তো আমাদের গাছ না, আমাদের নিজেদের যে গাছ সেগুলো থাকলেও পরিস্থিতির উন্নতি হতো। আবার দেখেন, কিছুদিন ধরে আমরা লক্ষ্য করছি, চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে। এর কারণ কী জানেন? তাপমাত্রা মাপার যে যন্ত্র সেটা চুয়াডাঙ্গাতে বসানো হয়েছে, সে কারণে ওখানের তাপমাত্রা বেশি দেখাচ্ছে। পাশের জেলা মেহেরপুরের তাপমাত্রা কি কম? আসলে না। এমন অনেক অসঙ্গতি আছে।”
তাপদাহের কারণে বাড়ছে রোগবালাই, হাসপাতালে তৈরি হচ্ছে রোগীর বাড়তি চাপ। দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহের তীব্রতা আরও বাড়ার শঙ্কায় তিন দিনের জন্য হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অফিস। গরমের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগবালাই। প্রচণ্ড গরমে ডায়ারিয়া, পেটের পীড়া, ঠান্ডা, জ্বর-কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, পানিশূন্যতা, হিটস্ট্রোক হচ্ছে। তীব্র গরমের কারণে সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে থাকে অসুস্থ, বয়স্ক ও শিশুরা। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়ার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি ও তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, কয়েক দিনের তাপপ্রবাহের কারণে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। গরমের সময়ের একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যগত সমস্যার নাম হিট স্ট্রোক।
চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী, প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, তাকে হিট স্ট্রোক বলে। শিশু ও বৃদ্ধদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিরা যেহেতু প্রায়ই বিভিন্ন রোগে ভোগেন যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস, কিডনি, লিভার বা হার্টের রোগী, স্ট্রোক বা ক্যানসারজনিত রোগে যারা ভোগেন, এমনকি যে কোনো কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা নানা ওষুধ সেবন করেন, যা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। ফলে গরমের দিনে কিছু সতর্কতা মেনে চললে হিট স্ট্রোকের বিপদ থেকে বেঁচে থাকা যায়। প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল পান করতে হবে। গরমে ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ দুইই বের হয়ে যায়। তাই পানির সঙ্গে সঙ্গে লবণযুক্ত পানীয় যেমন-খাবার স্যালাইন, ফলের রস, লাচ্ছি ইত্যাদিও পান করতে হবে।”
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, "বর্তমানে প্রচণ্ড গরমে ঠান্ডা, কাশি, জ্বর ও নিউমোনিয়ার রোগী বেশি আসছে। আমাদের হাসপাতালে গরমে রোগীর সংখ্যা
বেড়ে যায়, এখন কিছুটা রোগী বেড়েছে। এখন নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি।”
প্রতিবেদন: সমীর কুমার দে (ঢাকা)
2024-04-20T14:11:07Z dg43tfdfdgfd