ধরায় থাকলে ঠিকানা হত তিহার জেল

দেশপ্রেমের চেয়েও মহত্তর গুণ হল মানবতা। রবীন্দ্রনাথ শুধু এটা বিশ্বাসই করতেন না, জীবনভর অনুশীলন করতেন। হিংসাদীর্ণ পৃথিবীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসনকে লিখিতভাবেও তাঁর এই মনোভাবের কথা জানিয়েছিলেন। দেশপ্রেমকে তিনি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করতেন না। আর সে কারণেই দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের নামে মানবের নিষ্পেষণ মেনে নিতে পারেননি। দু'-দুটো বিশ্বযুদ্ধের বিষাক্ত নিঃশ্বাসের মূলে তিনি দেখেছেন জাতীয়তাবাদের উন্মত্ত আস্ফালন। তাই সংশয় ও সন্দেহের চোখে দেখতেন জাতীয়তাবাদকে।

দেশপ্রেমের নামে, জাতীয়তাবাদের নামে যে অত্যাচার ও অনাচার রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছেন, তা থেকেই তিনি জাতীয়তাবাদের কঠোর ও নির্মোহ সমালোচক ছিলেন। এর সেরা ক্রিটিক 'ঘরে বাইরে'। 'চার অধ্যায়' ও 'গোরা'-তেও তার স্পষ্ট প্রকাশ আছে। তবে অনেকের মতো আমারও মনে হয় 'ঘরে বাইরে'র সন্দীপ হচ্ছে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের প্রকৃষ্ট চরিত্র। যার বিপ্রতীপে নিখিলেশ, যার কাছে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ মানুষকে বাদ দিয়ে নয়, যা চূড়ান্ত অর্থে মানবিক। ন্যাশনালিজম ইন দ্য ওয়েস্ট বক্তৃতায় তিনি বলেন, নেশনের একমাত্র বাসনা অবশিষ্ট পৃথিবীর দুর্বলতার সুযোগে ফুলে ওঠা ও প্রতিবেশী সমাজগুলিকে গ্রাস করা, যার ফল হিসাবে গড়ে ওঠে পারস্পরিক ঈর্ষা ও আতঙ্কের পরিবেশ।

তিনি মনে করতেন জাতীয়তাবাদী চিন্তার মধ্যেই ক্ষমতা, আধিপত্য ও সংগ্রামের বীজ লুকিয়ে আছে, যা মানবজাতি ও সমাজব্যবস্থায় ভিন্নতা সৃষ্টি করে আর ব্যক্তি স্বাধীনতাকে আহত করে। মানুষ লোভ ও ক্ষমতার দ্বারা পরিচালিত হয়ে যন্ত্রে পরিণত হয়। তার ফলে সমাজের অভ্যন্তরস্থ নৈতিকতা, আদর্শ, মানুষের মধ্যেকার পারস্পরিক সহযোগিতা ও মানবিকতাবোধের বিলুপ্তি ঘটে। কবির দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদ স্বার্থকেন্দ্রিক মানুষের সম্মিলিত রূপ, যা কখনই মানবিক নয়, আত্মিক নয়। জাতীয়তাবাদ মানবিকতার প্রতি ভীতি প্রদর্শন আর মানুষের নৈতিকতা, অনুভূতি ও ঐক্যবোধকে পদদলিত করে।

আজ যখন আমাদের দেশে উন্মাদদের দেশপ্রেমে স্বভাবিক জীবনযাপন বিপন্ন হয়ে উঠছে,তখন রবীন্দ্রনাথ থাকলে নরেন্দ্রকে কী বলতেন, তা ভাবলেই আমার রোমাঞ্চ লাগে। তিনি এই মনুবাদী দেশপ্রেমী ও জাতীয়তাবাদীদের কীভাবে মোকাবিলা করতেন, তা আমাকে প্রায়ই ভাবায়। বিশেষ করে, বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক উত্থান। রবীন্দ্র আদর্শের প্রাসঙ্গিকতা এখন এই ভক্তিবাদের যুগে তলানিতে এসে ঠেকেছে। রাষ্ট্রনেতা থেকে সাধারণ ভোটদাতার মধ্যেও বিরাজ করছে অপরকে বিলোপ করার মানসিকতা। রবি ঠাকুর রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন, তাঁর জীবনের পরতে পরতে উদাহরণ রয়েছে।

প্রথম জীবনে স্বদেশি আন্দোলনের সময় বিদেশি দ্রব্য বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন কবিগুরু আবার শেষ জীবনে আন্তর্জাতিক হওয়ার কথা বলেছিলেন। রাজনীতির আঙিনায় রবীন্দ্রদর্শন ব্যক্তিগত উপলব্ধির পরিসর থেকে এসেছিল, তাই পরিবর্তনও হয়েছে কবির নিজের জীবনপটের অভিজ্ঞতায়। বলতে গেলে এক নতুন ধরনের রাজনীতির কথা বলেছিলেন তিনি। অনেকেই অবশ্য সেই রাজনীতির বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বারবার উঠে এসেছে সেই প্রসঙ্গ যে কবির আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার সঙ্গে কি তথাকথিত জাতীয়তাবাদের কোনও বিরোধ রয়েছে? আছে। ব্যাপকভাবে আছে। রবীন্দ্রনাথের মতে জাতির ধারণা পশ্চিমী ও সম্পূর্ণভাবে আধুনিক।

সেইসঙ্গে তিনি একে যান্ত্রিক ও রাজনৈতিক বলে ব্যাখ্যা করেছেন। জাতির মূল উদ্দেশ্য হল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে সমাজের অভ্যন্তরে আত্মনির্ধারণ আর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য অপরের ওপর বলপ্রয়োগের প্রচেষ্টা। কবি বলেছিলেন যে কোনো সমাজ যখন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে আর অপরের ওপর বলপ্রয়োগ শুরু করে তখন তা মানবজাতির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। কারণ তখন মানুষ ক্ষমতাকেই অগ্রাধিকার দিতে শুরু করে ও আধুনিক হওয়ার চরম নেশায় মত্ত হয়ে সম্পূর্ণ যান্ত্রিক হয়ে ওঠে। এর ফলে সমাজের মানবিক দিকটি ক্রমশ অবলুপ্ত হতে থাকে।

কবির মতে নেশনের আধুনিক ও যান্ত্রিক যৌক্তিকতার মধ্যে মানুষ প্রতিদিন নিজের স্বাধীনতা ও মানবিকতার বিসর্জন দিচ্ছে আর নিজে নেশনের যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। সেদিন হয়তো, কবির এই মনোভাব বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছিল, কিন্তু দিন যত গেছে, ততই এর সারবত্তা স্পষ্ট হচ্ছে। আমাদের ভোটসর্বস্ব রাজনীতিতে মানুষ তার ব্যক্তিগত পরিসরেও ভোটের বিরোধিতা করতে পারবে না। ভারতের মতো আধুনিক রাষ্ট্রে তাকে দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ন্যাশনালিজম-এ বলেছেন, 'যখন সংগঠনরূপী ইঞ্জিন বিশাল আকার গ্রহণ করে আর যন্ত্রকুশলীরা যন্ত্রের অংশ বিশেষে পরিণত হয়, তখন ব্যক্তিমানুষ শূন্যে বিলীন হয়ে যায়। আর অন্য সবকিছুই যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত মানব-অংশের দ্বারা উদ্ভাবিত নীতি বিপ্লব হিসাবে গণ্য হয় এবং তখন মমতাময় পরদুঃখকাতরতার দংশন বা কোন নৈতিক দায় থাকে না।'

রবীন্দ্রনাথ বিদেশি পণ্য জ্বালিয়ে দেওয়া, ধ্বংস করা ও চরকায় সুতো কাটার বিরোধী ছিলেন। এই ধরনের দেশপ্রেম তাঁর ধাতে সইত না। ১৯০৮ সালে বন্ধু এ এম বোসকে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখছেন, ‘দেশপ্রেম চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক আশ্রয় হতে পারে না। আমার আশ্রয় মানবতায়। আমি হীরের দামে কাচ কিনি না এবং যত দিন বেঁচে থাকি, কখনোই দেশপ্রেমকে মানবতার ওপর বিজয়ী হতে দেব না।’ এই বোধই আমরা 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসে নিখিলেশের গলায় শুনতে পাই।

নরেন্দ্র মোদী তাঁর অননুকরণীয় নাটকীয়তায় রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব বলে বন্দনা করে ভারতীয়দের বিশ্বাস করাতে চাইছেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদী। তিনি রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনাকে চিহ্নিত করেন ভক্তি আন্দোলনের ধারাবাহিকতা হিসেবে। অথচ আমরা তো জানি, প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু একনিষ্ঠভাবে একজন সনাতনী হিন্দু ছিলেন না। ছিলেন রামমোহন রায় প্রবর্তিত সংস্কারপন্থী ব্রাহ্মসমাজের একজন। তিনি মূর্তিপূজা ও প্রচলিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেমের চেয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদ ও মানবতাবাদকে অগ্রাধিকার দিতেন।

পাঁজিপুঁথির চেয়ে বেদ-উপনিষদকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তাঁর রচিত গান ও নাটকে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাই অহরহ। অথচ সেই গানকেই স্বদেশিরা আপন করে নিয়েছিলেন। সুধীর চক্রবর্তীর লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, 'অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া ' -- এই গানটিকে অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা মনে করতেন, তাঁদের জন্যই এটি কবিগুরুর লেখা। অথচ গীতবিতানে এটাকে আমরা প্রকৃতি পর্যায়ের গান হিসাবেই পাই। দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া -- এই ভাষ্যের মধ্যে বিপ্লবীরা খুঁজে পেতেন পদচিহ্নহীন পথে নিজেদের চলাকে।

নরেন্দ্র মোদী বা বিজেপি রবি ঠাকুরের এসব বৈশিষ্ট্যর ধারেকাছে দিয়ে না গিয়ে নিজেদের ধারণাতেই প্রচারের চেষ্টা চালিয়ে যান। কারণ নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল নিজেদের মনুবাদী উগ্র হিন্দুত্বকে বাংলায় প্রতিষ্ঠা করতে রবি সরনিকে আদর্শ উপায় বলে মনে করেন। তাই তাঁর ভাষণে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করার একট লক্ষণ দেখা যায়। কিছু অর্ধসত্য, কিছু অতিকথন বা মিথ ও কিছু কল্পরচনার ওপর ভিত্তি করে দেওয়া এই ভাষণে নরেন্দ্র মোদী কার্যত বাংলার ভোটারদের কাছে আহ্বান রাখতে চান, তাঁর রাজনীতি ও দলের জন্য দুয়ার খুলে দিতে।

এখানে এসেই মনে পড়ে, 'পথ ও পাথেয়'-তে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, 'আমি যাহা করিব সকলকেই তাহা করিতেই হইবে, আমি যাহা বলিব সকলকেই তাহা বলিতেই হইবে এইরূপ বলপ্রয়োগে দেশের সমস্ত মত ও আচরণ- বৈচিত্রের অপঘাতমৃত্যুর দ্বারা পঞ্চত্বলাভকেই আমরা জাতীয় ঐক্য বলিয়া স্থির করিয়া বসিয়াছি। মতান্তরকে আমরা সমাজে পীড়ন করিতেছি কাগজে অতি কুৎসিতভাবে গালি দিতেছি; এমন-কি, শারীরিক আঘাতের দ্বারাও বিরুদ্ধ মতকে শাসন করিব বলিয়া ভয় দেখাইতেছি।' অথচ আমরা এমন একটা সময় বেঁচে আছি, যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়ে দিয়েছেন, নবরাত্রি ও ‘সাবন’ চলার সময় আমিষ খেলে তা ‘মোগল-মানসিকতা’র প্রকাশ। জানা যাচ্ছে, দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমের বহু রাজ্যে এই সময় প্রশাসনের অঙ্গুলি নির্দেশে বাজারে কার্যত বন্ধ হয়ে যায় মাছ-মাংসের বিক্রি।

সংবিধান অনুসারে আহারের স্বাধীনতা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। এখানেই শাসকদলের সূক্ষ্ম কারসাজি— প্রথমে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া যে, ‘মোগল’ অর্থাৎ মুসলমানরা ভারতের শত্রু, তার পর আমিষাশীদের দেগে দেওয়া ‘মোগল’ বলে। এমন রাজত্বে সর্বভারতীয় বহুত্বকে হজম করা বিজেপির রাজনীতি নয়। আমিষ-নিরামিষের দ্বন্দ্ব অতীতে ছিল না এমন নয়, কৃষিপ্রধান সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই তা ছিল। গাঙ্গেয় অববাহিকায় উচ্চবর্ণের হিন্দু মূলত নিরামিষাশী, ফলে বিজেপির নৈতিকতা বলে, অন্তত পুজোপার্বণের সময় নিরামিষ খাওয়াই বিধেয়। কিন্তু আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতের মতো আমার সন্তান থাক শুধু মাছেভাতেও তো একটা ধারণা, একটা যাপন। অন্য অঞ্চলের সংস্কৃতিতে যে ভিন্ন কথা বলতে পারে, তা মানার মতো নমনীয়তা মনুবাদী বিজেপির নেই। তাই আজকের ভারতে রবীন্দ্রনাথ থাকলে নিস্তার পেতেন না। বিশেষত সেই রবীন্দ্রনাথ, যিনি অধিকার আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন।

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, 'প্রবাসী' পত্রিকায় লিখেছিলেন, 'সিভিল রাইটস কমিটি 'স্থাপনের কথা শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদিগকে প্রথমে বলিয়াছিলেন এবং তিনি ইহার কর্মী সভ্য হইতে প্রস্তুত ছিলেন। ১৯১৮ সালের ৫ মার্চ ওই অনুষ্ঠানে সম্পর্কে রামানন্দ লিখছেন, 'সেদিন রবীন্দ্রনাথের অসুখ। তাঁর লেখা পড়া হয় সভায়।' আমরা তো সবাই জানি, ১৯৩৬ সালের ২৪ আগস্ট জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে তৈরি হয় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সিভিল লিবার্টিজ। যার সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমন উদাহরণ আরও দেওয়া যায়। কথা হচ্ছে, আজকে যখন বিনাবিচারে, মিথ্যে মামলায় শ'য়ে শ'য়ে ভারতবাসীকে জেলে পুরে রাখার গৈরিক আনন্দে মোহিত মোদী-শাহরা, তখন রবীন্দ্রনাথ মানব শরীরে এই ধরাধামে থাকলে, তাঁরও বোধহয় ঠিকানা হত, তিহার জেল।

(এই প্রতিবেদনটি লেখকের নিজস্ব মতামতে প্রকাশিত। 'এই সময় ডিজিটাল' এর দায়ভার বহন করে না।)

এই ধরনের আরও খবর জানতে এই সময়ে আসুন। লেটেস্ট নিউজ, শহরের তাজা খবর, দেশের খবর, ব্যবসার খবর, খেলার আপডেট, দৈনিক রাশিফল এবং লাইফস্টাইলের টিপস জানুন। আর ভিডিয়োর জন্য রয়েছে TimesXP

2024-05-08T05:02:23Z dg43tfdfdgfd